Hi

ঢাকা ১০:২৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫, ৬ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

যে প্রথা মেনে দুই ভাইকে বিয়ে করেন ভারতের ওই নারী

ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিরমৌর জেলার একটি বিয়ে নিয়ে একদিকে যেমন ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, তেমনই বিতর্কও দেখা গেছে।
সিরমৌরের শিলাই গ্রামেরই দুই ভাই প্রদীপ নেগি ও কপিল নেগিকে একইসঙ্গে বিয়ে করেছেন সুনিতা চৌহান নামে এক নারী।
তফসিলি জনজাতি হিসেবে নথিভুক্ত হাটি সম্প্রদায়ের পুরোনো বহুপতিত্ব প্রথা মেনেই এই বিয়ে। স্থানীয় ভাষায় একে ‘জোড়িদারা’ বা ‘জাজড়া’ বলা হয়।
সিরমৌরের ট্রান্স-গিরি এলাকায় আয়োজিত এই বিয়ের অনুষ্ঠানে দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজনরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শত শত গ্রামবাসী। বিয়েতে ঐতিহ্যবাহী লোকগান, নাচ আর ব্যঞ্জনের সমারোহ ছিল।
হাটি সম্প্রদায়ের পুরোনো প্রথা মেনে এই বিয়ে হলেও বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এই রীতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে।

কী এই প্রথা?
পাত্রী সুনিতা চৌহানের পরিবার সিরমৌর জেলার কুঁহাট গ্রামের বাসিন্দা। পাত্রদের গ্রাম শিলাই থেকে কুঁহাটের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। শিমলা থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে ওই অঞ্চল।
পাত্র এবং পাত্রী দুই পক্ষের পরিবারই হাটি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। সিরমৌর জেলার ট্রান্স-গিরি অঞ্চল ছাড়াও হাটি সম্প্রদায়ের মানুষ উত্তরাখণ্ডের জৌনসার-বাওয়ার এবং রাওয়াই-জৌনপুর অঞ্চলে বসবাস করেন।
এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুপতিত্ব বা এক নারীর একাধিক স্বামী গ্রহণের রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রয়েছে।
এই প্রথা মেনে, হাটি সম্প্রদায়ের নারীরা একই পরিবারের দুই বা তার বেশি ভাইকে বিয়ে করতে পারেন। এই বিয়ে পরিবারের সম্মতিক্রমে হয় এবং বাড়ির দায় দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধরা।
সিরমৌর ছাড়াও সিমলা, কিন্নর এবং লাহুল স্পিতির কিছু অংশেও এই প্রথা মেনে বিয়ে হয়।
কেন এই প্রথার চল?
যারা এই প্রথা সম্পর্কে অবগত, তাদের মতে এর নেপথ্যে বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে।
পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য বজায় রাখা এবং পৈতৃক সম্পত্তির বিভাজন হওয়া থেকে রোধ করাই ছিল এই প্রথার লক্ষ্য।
স্থানীয় বাসিন্দা কপিল চৌহান বলেন, “জোড়িদারা প্রথা আমাদের পরিচয়। এই প্রথা সম্পত্তির বিভাজন রোধ করতে, যৌতুক প্রথা এড়াতে, ভাইদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে এবং সন্তান লালন-পালন করতে সাহায্য করে।”
তিনি জানিয়েছেন শিলাই এলাকার প্রায় প্রতিটা গ্রামেই চারটে থেকে ছয়টা পরিবার এই প্রথা অনুসরণ করে।
সুনিতা চৌহানের সঙ্গে কপিল নেগি ও প্রদীপ নেগির বিয়ে নিয়ে যে ধরনের আলোচনা হচ্ছে, সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, “আমি বহুদিন ধরেই এই বিষয়ে জানতাম। এই ঘটনা হঠাৎ ঘটেনি। এটা আমাদের একটা প্রথাগত ঐতিহ্য। আমাদের জন্য এটা গর্বের বিষয়।”
“যতক্ষণ পর্যন্ত পাত্ররা, পাত্রী এবং তাদের পরিবার এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে ততক্ষণ অন্য কারো এতে কিছু বলার নেই।”
তিনি আরও বলেন, “বিষয়টা স্বীকার করে নেওয়া উচিত। এখন তো মানুষ লিভ-ইন রিলেশনশিপের বিষয়ও সহজে মেনে নেন।”

ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তি
ট্রান্স-গিরি অঞ্চলের সঙ্গে ‘জোড়িদারা’ প্রথার যোগ বেশ গভীর বলে মনে করা হয়।

এই প্রথাকে জুড়ে দেওয়া হয় মহাভারতের দ্রৌপদীর কাহিনীর সঙ্গেও। যে কারণে অনেকে এটকে ‘দ্রৌপদী প্রথা’ও বলে থাকেন।

হিমাচল প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ড. ওয়াই এস পারমার তার বই ‘পলিয়ান্ড্রি ইন দ্য হিমালয়াস’-এ ‘জোড়িদার’ প্রথার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ সম্পর্কে বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন।

ওই বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, “এই প্রচলন শুরু হয়েছিল পার্বত্য অঞ্চলে বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতিতে যেখানে সীমিত কৃষিজমিকে একত্রিত করার প্রয়োজনীয় ছিল।”

হাটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত পণ্ডিত ও সমাজকর্মী আমিচাঁদ হাটি বলেন, “এই প্রথার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এবং এটা সম্প্রদায়ের ঐক্য ও ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। একে সম্প্রদায়ের মূল্যবোধের সংরক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।”

কেন্দ্রীয় হাটি কমিটির সাধারণ সম্পাদক কুন্দন সিং শাস্ত্রী বলছেন, এই প্রথা বহু পুরনো। পরিবারের ঐক্য বজায় রাখাই এর উদ্দেশ্য।

ট্যাগ :
জনপ্রিয়

ঝিনাইদহে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর বিতরণে শিক্ষা অফিসারদের চাঁদাবাজী

যে প্রথা মেনে দুই ভাইকে বিয়ে করেন ভারতের ওই নারী

আপডেট : ০৩:২৯:০৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

ভারতের হিমাচল প্রদেশের সিরমৌর জেলার একটি বিয়ে নিয়ে একদিকে যেমন ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, তেমনই বিতর্কও দেখা গেছে।
সিরমৌরের শিলাই গ্রামেরই দুই ভাই প্রদীপ নেগি ও কপিল নেগিকে একইসঙ্গে বিয়ে করেছেন সুনিতা চৌহান নামে এক নারী।
তফসিলি জনজাতি হিসেবে নথিভুক্ত হাটি সম্প্রদায়ের পুরোনো বহুপতিত্ব প্রথা মেনেই এই বিয়ে। স্থানীয় ভাষায় একে ‘জোড়িদারা’ বা ‘জাজড়া’ বলা হয়।
সিরমৌরের ট্রান্স-গিরি এলাকায় আয়োজিত এই বিয়ের অনুষ্ঠানে দুই পক্ষের আত্মীয়স্বজনরা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন শত শত গ্রামবাসী। বিয়েতে ঐতিহ্যবাহী লোকগান, নাচ আর ব্যঞ্জনের সমারোহ ছিল।
হাটি সম্প্রদায়ের পুরোনো প্রথা মেনে এই বিয়ে হলেও বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে এই রীতি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে।

কী এই প্রথা?
পাত্রী সুনিতা চৌহানের পরিবার সিরমৌর জেলার কুঁহাট গ্রামের বাসিন্দা। পাত্রদের গ্রাম শিলাই থেকে কুঁহাটের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। শিমলা থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে ওই অঞ্চল।
পাত্র এবং পাত্রী দুই পক্ষের পরিবারই হাটি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। সিরমৌর জেলার ট্রান্স-গিরি অঞ্চল ছাড়াও হাটি সম্প্রদায়ের মানুষ উত্তরাখণ্ডের জৌনসার-বাওয়ার এবং রাওয়াই-জৌনপুর অঞ্চলে বসবাস করেন।
এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুপতিত্ব বা এক নারীর একাধিক স্বামী গ্রহণের রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রয়েছে।
এই প্রথা মেনে, হাটি সম্প্রদায়ের নারীরা একই পরিবারের দুই বা তার বেশি ভাইকে বিয়ে করতে পারেন। এই বিয়ে পরিবারের সম্মতিক্রমে হয় এবং বাড়ির দায় দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধরা।
সিরমৌর ছাড়াও সিমলা, কিন্নর এবং লাহুল স্পিতির কিছু অংশেও এই প্রথা মেনে বিয়ে হয়।
কেন এই প্রথার চল?
যারা এই প্রথা সম্পর্কে অবগত, তাদের মতে এর নেপথ্যে বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে।
পরিবারের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য বজায় রাখা এবং পৈতৃক সম্পত্তির বিভাজন হওয়া থেকে রোধ করাই ছিল এই প্রথার লক্ষ্য।
স্থানীয় বাসিন্দা কপিল চৌহান বলেন, “জোড়িদারা প্রথা আমাদের পরিচয়। এই প্রথা সম্পত্তির বিভাজন রোধ করতে, যৌতুক প্রথা এড়াতে, ভাইদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে এবং সন্তান লালন-পালন করতে সাহায্য করে।”
তিনি জানিয়েছেন শিলাই এলাকার প্রায় প্রতিটা গ্রামেই চারটে থেকে ছয়টা পরিবার এই প্রথা অনুসরণ করে।
সুনিতা চৌহানের সঙ্গে কপিল নেগি ও প্রদীপ নেগির বিয়ে নিয়ে যে ধরনের আলোচনা হচ্ছে, সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, “আমি বহুদিন ধরেই এই বিষয়ে জানতাম। এই ঘটনা হঠাৎ ঘটেনি। এটা আমাদের একটা প্রথাগত ঐতিহ্য। আমাদের জন্য এটা গর্বের বিষয়।”
“যতক্ষণ পর্যন্ত পাত্ররা, পাত্রী এবং তাদের পরিবার এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে ততক্ষণ অন্য কারো এতে কিছু বলার নেই।”
তিনি আরও বলেন, “বিষয়টা স্বীকার করে নেওয়া উচিত। এখন তো মানুষ লিভ-ইন রিলেশনশিপের বিষয়ও সহজে মেনে নেন।”

ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তি
ট্রান্স-গিরি অঞ্চলের সঙ্গে ‘জোড়িদারা’ প্রথার যোগ বেশ গভীর বলে মনে করা হয়।

এই প্রথাকে জুড়ে দেওয়া হয় মহাভারতের দ্রৌপদীর কাহিনীর সঙ্গেও। যে কারণে অনেকে এটকে ‘দ্রৌপদী প্রথা’ও বলে থাকেন।

হিমাচল প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ড. ওয়াই এস পারমার তার বই ‘পলিয়ান্ড্রি ইন দ্য হিমালয়াস’-এ ‘জোড়িদার’ প্রথার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ সম্পর্কে বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন।

ওই বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, “এই প্রচলন শুরু হয়েছিল পার্বত্য অঞ্চলে বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতিতে যেখানে সীমিত কৃষিজমিকে একত্রিত করার প্রয়োজনীয় ছিল।”

হাটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত পণ্ডিত ও সমাজকর্মী আমিচাঁদ হাটি বলেন, “এই প্রথার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এবং এটা সম্প্রদায়ের ঐক্য ও ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। একে সম্প্রদায়ের মূল্যবোধের সংরক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।”

কেন্দ্রীয় হাটি কমিটির সাধারণ সম্পাদক কুন্দন সিং শাস্ত্রী বলছেন, এই প্রথা বহু পুরনো। পরিবারের ঐক্য বজায় রাখাই এর উদ্দেশ্য।